বাংলার সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন এবং কল্যাণকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময়েই পশ্চিমবঙ্গ সরকার নানান প্রকল্প চালু করেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে আর্থিক সহায়তা—প্রতিটি ক্ষেত্রেই মেয়েদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে রাজ্য সরকার। এর মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছেন রাজ্যের বহু মহিলারা। এবার মেয়েদের জন্য রয়েছে আরেকটি জনপ্রিয় উদ্যোগ যার মাধ্যমে মেয়েদের দেওয়া হবে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ২৫ হাজার টাকা করে। এর মধ্যেই সবচেয়ে আলোচিত এবং সাধারণ মানুষের কাছে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে রূপশ্রী প্রকল্প। যদিও অনেকেই নাম শুনেছেন, কিন্তু প্রকল্পটির আসল উদ্দেশ্য, নিয়মকানুন, শর্তাবলী এবং আবেদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানেন না।

এই প্রতিবেদনে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো রূপশ্রী প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা, নিয়ম, শর্ত, প্রয়োজনীয় নথি, আবেদন প্রক্রিয়া, সুবিধাভোগী নির্ধারণের নিয়ম এবং শেষ পর্যন্ত কারা এর থেকে প্রকৃত উপকৃত হবেন।
কেন রূপশ্রী প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ?
বর্তমান সমাজে এখনও আর্থিক সংকটের কারণে বহু পরিবার মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন। বিশেষ করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র পরিবারে আর্থিক সঙ্কট মেয়েদের শিক্ষার পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষেত্রেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই সমস্যার সমাধানে সমাজে নারীর উন্নয়ন এবং সুরক্ষিত ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই রাজ্য সরকার এই প্রকল্প চালু করেছে। এর মাধ্যমে ভীষণভাবে উপকৃত হচ্ছেন রাজ্যবাসীরা।
এই প্রকল্প শুধু আর্থিক অনুদান দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সমাজে নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করারও একটি পদক্ষেপ। মেয়েরা যেন সমাজে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজের জায়গা করে নিতে পারে, সেটাই মূল লক্ষ্য।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য
রূপশ্রী প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়—
- নারী কল্যাণ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা – মেয়েদের যাতে আর্থিক কারণে জীবনে পিছিয়ে যেতে না হয়।
- দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারকে সহায়তা করা – নিম্ন আয়ের পরিবারগুলির জন্য এটি কার্যকর সমাধান, এর ফলে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।
- সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা – সমাজে নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন ও সমতা আনার প্রচেষ্টা।
কারা এই প্রকল্পে আবেদন করতে পারবেন?
প্রকল্পের সুবিধা সব মেয়ে পেলেও তা নির্দিষ্ট কিছু শর্তের ভিত্তিতে দেওয়া হয়। আবেদনকারীর অবশ্যই কিছু মানদণ্ড পূরণ করতে হবে। যেমন—
- আবেদনকারীর বয়স অবশ্যই ১৮ বছরের বেশি হতে হবে।
- আবেদনকারীকে পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে।
- অন্তত গত ৫ বছর ধরে রাজ্যে বসবাসের প্রমাণ থাকতে হবে।
- আবেদনকারীর পরিবারের বার্ষিক আয় ১.৫ লক্ষ টাকার কম হতে হবে।
- আবেদনকারীর অবশ্যই নিজের নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে।
এই নিয়মগুলো মান্য না করলে আবেদন গ্রহণযোগ্য হবে না।
কী কী নথি লাগবে?
প্রকল্পে আবেদন করার সময় আবেদনকারীর পরিচয় ও যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি জমা দিতে হবে। এগুলো হলো—
- বয়সের প্রমাণপত্র: জন্ম সনদ / আধার কার্ড / ভোটার কার্ড / প্যান কার্ড
- বাসস্থানের প্রমাণ: রেশন কার্ড / আধার কার্ড/ভোটার কার্ড
- পরিবারের আয়ের প্রমাণপত্র (Self Declaration বা সরকারি সনদ)
- আবেদনকারীর ব্যাঙ্ক পাসবুকের কপি
- প্রার্থী ও প্রস্তাবিত পাত্রের বয়সের প্রমাণপত্র
- প্রার্থী এবং প্রস্তাবিত পাত্রের রঙিন পাসপোর্ট সাইজ ছবি
- বিবাহের নির্ধারিত তারিখের প্রমাণপত্র (যদি প্রযোজ্য হয়)
আবেদন পদ্ধতি
রূপশ্রী প্রকল্পে আবেদন করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু ধাপ অনুসরণ করতে হবে—
- ফর্ম সংগ্রহ করুন – ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিস, মিউনিসিপ্যালিটি, কর্পোরেশন বা সাব-ডিভিশনাল অফিস থেকে আবেদন ফর্ম পাওয়া যায়। এছাড়াও wbcdwdsw.gov.in ওয়েবসাইট থেকেও ডাউনলোড করা যায়।
- ফর্ম পূরণ করুন – নির্ধারিত তথ্য সঠিকভাবে লিখতে হবে এবং প্রমাণপত্র যুক্ত করতে হবে। কোন ভুল তথ্য দিলে টাকা পাওয়া যাবে না।
- নথি সংযুক্ত করুন – বয়স, আয়ের প্রমাণ, বাসস্থানসহ সমস্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হবে।
- ফর্ম জমা দিন – নির্ধারিত অফিসে, বিয়ের তারিখের অন্তত ৩০ থেকে ৬০ দিন আগে ফর্ম জমা দিতে হবে।
- যাচাই প্রক্রিয়া – জমা দেওয়া তথ্য ও নথি যাচাই করা হবে। সবকিছু সঠিকভাবে দিতে হয়।
- অর্থ সরাসরি ব্যাঙ্কে জমা হবে – সবকিছু সঠিক হলে আবেদনকারীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা পাঠানো হবে।
রূপশ্রী প্রকল্পকে আলাদা করে তোলে এর সরাসরি ব্যাঙ্ক ট্রান্সফারের ব্যবস্থা। অর্থাৎ এখানে কোনো মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেই। ফলে দুর্নীতি বা জালিয়াতির সুযোগ অনেকটাই কম। সরাসরি ব্যাংক একাউন্টে টাকা দেওয়া হয়।
এছাড়া প্রকল্পের সবচেয়ে বড় দিক হলো, এটি গ্রামীণ ও শহরাঞ্চল উভয় জায়গার মেয়েদের জন্য সমানভাবে কার্যকর। যেকোনো প্রান্তের মানুষ এই সুবিধা নিতে পারেন।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই রূপশ্রী প্রকল্প আসলে মেয়েদের জন্য এক সামাজিক সুরক্ষা ঢাল। এটি শুধু টাকার সহায়তা নয়, বরং আর্থিক সঙ্কটে থাকা পরিবারকে মানসিকভাবে শক্তি জোগায়। প্রকল্পটি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে শুধুমাত্র প্রকৃত দরিদ্র পরিবাররাই উপকৃত হয় এবং সমাজে নারীর সম্মান বজায় থাকে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের মেয়েরা বিভিন্নভাবে উপকৃত হচ্ছে।
সবচেয়ে বড় দিক হলো, এই প্রকল্পের অধীনে রাজ্যের কোনো মেয়ের বিয়ের জন্য সরকার এককালীন ২৫,০০০ টাকা প্রদান করে থাকে। তবে এই তথ্যটি ইচ্ছে করেই সবশেষে বলা হলো, কারণ রূপশ্রী প্রকল্পের মূল লক্ষ্য শুধু বিয়ের খরচে অনুদান দেওয়া নয়, বরং মেয়েদের জীবনযাত্রা সুরক্ষিত করা এবং তাদের পাশে দাঁড়ানো।
